
সাহারা
January 27, 2025
জোছনায় ফুল ফুটেছে পান্ডুলিপি তৈরীর গল্প
February 1, 2025লন্ডন আমার আত্মার চোখ খুলে দিয়েছে। এখানে এসে, দিন দিন পরিপক্বতা বাড়ছে, চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে, বুঝার ক্ষমতা বাড়ছে, মন উদার হচ্ছে। চারিদিকের বিশালতা বাড়ছে। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখছি। লন্ডনে যখন এলাম, প্রথম দিকে তেমন কোনো কাজ ছিল না। শুধু কলেজ, আর মাঝে মাঝে জব খোঁজা। এই যা। আর বাকিটা সময় প্রতিদিনই প্রায় কোথাও না কোথাও ঘুরে বেড়াতাম। একদিন হোয়াইট চ্যাপেল ঘুরতে গেলাম। বাঙালি পাড়া। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালাম। ফুটপাতে কতশত দোকান পেতে বসেছে। হরেকরকমের জিনিস বিক্রি হচ্ছে। যেন আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জের সেই চিরচেনা হাট বসেছে। খুব আনন্দ লাগল। সাহেবি টুপি, কোট, টাই পরে একজন মধ্য বয়সি বাঙালিকে দেখলাম, ভিড়ের মধ্যে সিগারেট বিক্রি করছে। বাংলা ব্যানসন সিগারেট। ওয়ান প্যাকেট মাত্র চার পাউন্ড।
এক প্যাকেট কিনে নিলাম। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে ধরলাম। টানতে টানতে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। কিছু দূর এগোতে দেখলাম, একজন আংটি বিক্রি করছে। অনেক রকম পাথর বসানো আংটি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। একটা আংটি খুব পছন্দ হলো। আকাশি রঙের পাথর বসানো। নিতে ইচ্ছা করল। স্পর্শ করতে যেতেই, লোকটি হাসিমুখে ইশারায় ধরতে না করল। সে খুব সাবধানে একটা সাদা রুমাল প্রজাপতির মতো উড়িয়ে অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে আংটিটি তুলে দেখালো। দৃশ্যটি খুব ভালো লাগল। সবকিছুর মধ্যে একটা নিখুঁত শিল্প লুকিয়ে রয়েছে। আংটিটি কিনে নিলাম। আঙ্গুলে পরলাম। পরার পর মনে হলো মন থেকে কালো কী যেন একটা দূর হয়ে গেল। মুহূর্তে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। আসলে আংটির জাদু নয়, লোকটির প্রজাপতির মতো রুমাল উড়ানো, তার সুন্দর এক্সপ্রেশন আমাকে মুগ্ধ করে তুলেছিল। সুন্দর কিছু ভাবিয়েছিল। লন্ডন আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশনের মুখে একজন বৃদ্ধকে দেখলাম ফুল বিক্রি করছে। অনেক রকম ফুলের পশরা সাজিয়ে বসেছে। বৃদ্ধের বয়স নব্বই কী পঁচানব্বই বছর হবে। ফুলের মধ্যে এমন ভাবে বসে আছে যে, গভীর ভাবে লক্ষ না করলে, তার মুখ দেখার কোন উপায় নেই। ফুলের সঙ্গে মুখটা মিশে আছে। বৃদ্ধকে দেখে খুব মায়া হলো। এ বয়সে এসে ফুল বিক্রি করছে। কষ্ট করে উপার্জন করছে। একটা ফুল কিনে নিয়ে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলামÑ আপনি ফুল বিক্রি করছেন কেন? আপনার তো অনেক বয়স হয়েছে? বৃদ্ধ বললেন, তাহলে কী করব?
এ বয়সে আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আপনাদের তো বৃদ্ধ ভাতা আছে। ভাতা দিয়ে খুব ভালোভাবে চলতে পারেন।
বৃদ্ধ লোক আমার প্রতি একটু রাগ করলেন। থমথমে গলায় বললেন, আমি কেন দেশের ঘাড়ে বসে খাব? আমার কী কর্ম নেই? আমি কর্ম করতে জানি, রোজগার করতে জানি। ফুল বিক্রি করে ভালোভাবে আমার সংসার চলে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো।
বৃদ্ধের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। তার কথা আমার চিন্তার দরজা খুলে দিলো। সঠিক কথাই বলেছেন। এ হাত হবে সম্মানের হাত, লাঞ্ছনার হাত হবে কেন? সেদিন আমার জীবনে আরেকটি পরিবর্তন এসে গেল।
লন্ডন ভালো লাগছে। দিনগুলি সুন্দর কাটছে। কে নো সমস্যা হচ্ছে না। উন্নত দেশ, উন্নত মানুষ, উন্নত চিন্তা। সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছি। মাঝে মাঝে জব বিষয়ে একটু আধটু চিন্তা এসে যায়, এখন পাত্তা দেই না। সমস্যা যখন বের হয়ে গেছে, একদিন হঠাৎ সমাধানও বের হয়ে যাবে। মুহূর্তটি আমি নিজেও বুঝতে পারব না। এ বয়সে, এ জীবনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু পেয়েছি।