
বাবার কাছে লেখা চিঠি
January 27, 2025
ওয়ান প্যাকেট মাত্র চার পাউন্ড।
January 27, 2025শৈশবে রূপকথার বৃদ্ধ কাঠুরের গল্পটি আমার খুব প্রিয় ছিল। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে একবার হলেও শুনতে চাইতাম।
এক গ্রামে বাস করত বৃদ্ধ কাঠুরে। সারা দিন বনজঙ্গলে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফিরত। রাতে খাবার খেয়ে সুখের ঢেকুর তুলত। প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় সে প্রাচীন এক গাছের ছোট ছোট গর্তে আগুন ধরিয়ে আলো জ্বালাত। এতে গ্রামের সবাই বুঝতে পারত আজ রাতে গল্পের আসর বসবে। পুরুষ-মহিলারা সবার কাজ শেষে একে একে গাছের নিচে জড়ো হতো। সবাই একত্রিত হলে বৃদ্ধ কাঠুরে গল্প বলা শুরু করত। অসাধারণ ভঙ্গি ও গল্প বলার ক্ষমতা ছিল তার। এক-একদিন একেকভাবে গল্প শুরু করত। সবাই গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ত।
এই বৃদ্ধ কাঠুরে গল্পকারের মতো একজন গল্পকার আমি বাস্তবে খুঁজে পেয়েছিলাম। গল্প বলার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তাঁর। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘরের দরজার সামনে হারিকেন জ্বালিয়ে টুল নিয়ে বসে যেতেন গল্প বলতে। গ্রামের পুরুষ-মহিলা-বৃদ্ধ সবাই এক এক করে তার বাড়ির আঙিনায় জড়ো হতো। একটার পর একটা গল্প চলত। একটা সময় শুরু হতো গা ছমছম করা ভূতের গল্প।
রাতে গ্রামের নতুন বউ ইলিশ মাছ ভাজছে। গন্ধে গন্ধে ভুত এসে উপস্থিত। গৃহস্থবাড়ির কারও রূপ ধরে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নাকি গলায় ভুত বলে, ভাঁজামাছ দিবি একটা ?
গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে পানসুপারির পর্ব।
এই গল্পকারের নাম সাহারা। আমার দাদি। দাদি মুগ্ধ হতে ভালোবাসতেন। অন্যদেরও মুগ্ধতায় জড়িয়ে ফেলতেন। দাদি থাকতেন গ্রামের বাড়িতে।
গ্রামে আমার বাবার বাগানবাড়ির মতো সুন্দর একটা বাড়ি আছে। দাদার মৃত্যুর পর দাদি সেই বাড়িতে স্থায়ী হয়ে গেলেন। এই স্বপ্নবাড়িতে বাবার থাকার কথা থাকলেও পারলেন না। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। আমাদের মানুষের মতো মানুষ করতে হবে।
রহিমপুর গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। আমরা তাই চলে এলাম বকশিগঞ্জ উপজেলায়। এখানে বাবা নতুন একটা বাড়ি করলেন। টিনের চালের হাফবিল্ডিং। সামনে ফুলফলের গাছে ভর্তি। বাবা দাদিকে বললেন, মা আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
দাদি বললেন, এখানে জানালা দিয়ে তাকালেই তোর বাবার কবরটা দেখা যায়!
তিনি আমাদের সঙ্গে নতুন বাড়িতে এলেন না।
দাদির স্বভাব ছিল যখন-তখন দিন নেই রাত নেই বাড়ির আঙিনা, কাঁঠালবাগান, আমবাগানের চারপাশে হেঁটে বেড়ানো। জোছনায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছেন বাঁশবাগানে।
বাঁশের চিকন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে অবাক জোছনা দেখতে দেখতে কোথায় কোন সুদূরে হারিয়ে যেতেন। এদিকে তাঁর বড় ছেলের কথাও খুব মনে পড়ছে। দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাগিনা হযরত আলীকে রিকশা ডাকতে পাঠাতেন। দুটো লাল মোরগ হাতে নিয়ে হযরত আলীর সঙ্গে রাতেই চলে আসতেন বকশিগঞ্জের বাসায়। আমরা ভাইবোন মিলে আনন্দে দাদিকে জড়িয়ে ধরতাম।
বাবা আধো রাগ আধো আনন্দমিশ্রিত গলায় বলতেন, মা, আপনি কি পাগল ? এই রাতেই আসতে হয় ? রাস্তাঘাটে কত রকম বিপদ!
দাদি এসব কথা গায়ে মাখাতেন না। হযরতকে দিয়ে রাতেই মোরগ দুটো জবাই করাতেন। আমরা আরও উল্লাসে মেতে উঠতাম। আম্মা আনন্দের সঙ্গে তাকের ওপর থেকে নতুন পাতিল পেড়ে আনতেন।
চাল-ডাল একসঙ্গে মেখে আঙিনায় লাকড়ি চুলায় খিচুড়ি বসিয়ে দিতেন। জোছনায় নতুন টিনের চাল জ্বলজ্বল করত।
নিশিপাখিরা ডেকে উঠত -হুদ হুদ হুততুম হুদ। কক্ ক...
ভয়জাগানিয়া শব্দ। অপূর্ব জোছনারাত! রহস্য রহস্য একটা পরিবেশ। দাদি হঠাৎ আম্মার সঙ্গে গল্প শুরু করতেন।
বড় বউ, উত্তরের মাথায় কাঁঠালগাছটা আছে না ? ওই গাছে মাসখানেক থেকে একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
কী ঘটছে ?
সপ্তাহখানেক আগেও দেখেছি।
কী ?
রাতে হাঁটতে হাঁটতে কাঁঠালগাছটার নিচে দাঁড়িয়েছি। দেখি রেশমি কাপড় পরে একজন সুন্দরমতন বসে আছে।
স্কুলের ছুটিছাটায় বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যেতেন। দাদি আমাদের কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হতেন। তার সব ছেলেমেয়েকে একত্রিত করতেন। বাড়িতে যেন একটা সতেজ ভাব ফুটে উঠত। প্রাণ ফিরে পেত। চারদিকে ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি। দাদি জায়গায় জায়গায় হযরত আলীকে পাঠিয়ে গ্রাম্য গায়কদের আনাতেন। রাতে বাড়ির পেছনের উঠোনে গানের আসর বসত। ঢেউখেলানো সুর আর মাথার বাবরির ঝাঁকুনি শ্রোতাদের মনে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যেত। গভীর রাত পর্যন্ত গানবাজনা চলত। মাঝখানে এসে আমরা ছোটরা ঘুমিয়ে পড়তাম। একসময় আধো ঘুম ঘুম চোখে নিজেকে বিছানায় মায়ের পাশে আবিষ্কার করতাম। সেখান থেকেও ঘুমের মধ্যে গানের মিষ্টি সুর শুনতে পেতাম।
বাবা হলেন যান্ত্রিক মানুষ। গানবাজনা, গল্প, আড্ডা, দাদির আধ্যাত্মিক কথাবার্তা কিছু বুঝতেন না। তিনি ভাবতেন আমরা এখানে বেশিদিন থাকলে নষ্ট হয়ে যাব—তাই অল্প কিছুদিন পরই আমাদের নিয়ে বকশিগঞ্জে ফিরতেন। যখন আমাদের বিদায় নেওয়ার সময় হতো তখন দাদি শোকে পাথর হয়ে যেতেন। গাছটায় ঠেস দিয়ে যতদূর রিকশায় চোখ যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন।
ধান কাটার মৌসুমে আম্মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একাই গ্রামে যেতেন। কামলা-কিষানরা ধান কেটে এনে উঠোনে জমা করতেন। ধানের মৌ মৌ গন্ধে সমস্ত বাড়ি ভরে উঠত। দাদি আমাকে নিয়ে অন্ধকার রাতে বাঁশবাগানে জোনাক পোকার জ্বলা-নিভার দৃশ্য দেখাতেন। হঠাৎ দমকা বাতাসে টুপ টুপ বৃষ্টির মতো আম পড়ত। দাদি তখন বালিকার মতো আনন্দে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতেন। আম পড়েছে! আম পড়েছে! কোনো কোনো রাতে দাদিকে বিছানায় পাওয়া যেত না। নিঃশব্দে উঠে কোথায় যেন গিয়েছেন। আম্মা তখন হারিকেন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করতেন। যখন দাদি ফিরতেন তখন আম্মা জিজ্ঞেস করতেন, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন ?
দাদি লাজুক স্বরে বলতেন, তোমার শ্বশুরের কবরটা দেখতে। পুরান বাড়ি থেকে একটু ঘুরে এলাম।
তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। একা গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছি। দাদি পিঠা-পায়েস তৈরি করেছেন। পোলাও-মাংস রেঁধেছেন। খাবার খেয়ে বিছানায় বসে আছি। বিছানা ঘেঁষে জানালা। দাদি জানালা খুলে দিয়ে রহস্যময় হাসি হাসছেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, জানালা দিয়ে বাতাসে হু হু করে আতা ফুলের মন মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছে। ঝিঁঝি পোকার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দাদির ডাকে—নিশো! নিশো!
জি, দাদি।
ঘুমাচ্ছিলি ?
হ্যাঁ। আপনার ডাকে ঘুম ভাঙল। আপনি কী করছেন ?
তোর দাদার সঙ্গে কথা বলছিলাম। এই দরজার কাছে তোর দাদা কথা বললেন। যুবক বয়সের গলা। নানান বিষয়ে খোঁজখবর করলেন।
আমার সমস্ত শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। যদিও রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পের মতো সমস্তটাই ভূতের গল্প। অথচ কোথাও কোনো ভূতের উপস্থিতি নেই।
দাদি মারা গেলেন। আমিও বড় হয়ে গেলাম। পড়াশোনার চাপ বাড়তে থাকল। নানা ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি।
মানুষের মনের সঙ্গে মনের একটা যোগসূত্র আছে। বিয়েশাদি করে ঢাকায় সংসার সাজিয়েছি। বাবার অনেক বিষয়সম্পত্তি থাকলেও আমার সংসার বড় অভাবের। দাদির কথা খুব মনে পড়তে লাগল। সেইসঙ্গে হযরত আলী চাচাকেও। একদিন অফিস থেকে বিকেলে বাসায় ফিরেছি। দেখি, হযরত আলী চাচা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। অবাক হয়ে গেলাম। লেখক হিসেবে আমার নামডাক ছড়ায় নি। কেউ আমাকে চিনে না। হযরত আলী চাচা তবুও নাম বলে বলে, জিজ্ঞেস করে করে বাসা খুঁজে বের করে ফেলেছেন। এমনকি ট্রেনের মধ্যেও অতি উৎসাহী গলায় অনেকের সঙ্গে বলেছেন, লেখক নিশো আল মামুনের বাসায় যাচ্ছি।
খুব আনন্দ নিয়ে বাজার করতে গেলাম। প্রকাণ্ড একটা চিতল মাছ আর ঝাঁকাভর্তি মুরগি নিয়ে এলাম। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর প্রাণ খুলে গল্প করলাম।
শৈশবে অল্প কিছু মানুষ আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। তাদের মধ্যে হযরত আলী চাচা একজন। এর বছর খানেক পর আমার আশৈশব গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। নিঃশব্দে তালা খুলে দাদির ঘরে বসেছি।
দুপুরবেলা। বসন্তের পাখির ডাক কানে ভেসে আসছে। কোওকো কোওকো (বউ কথা কও)। আর একটা পাখি বিকট শব্দে গলা ছেড়ে গানের রেওয়াজ করছে। অতি মিষ্টি সুর। কোকিল তো প্রাণ খুলে ডাকছেই।
পাখির মধুর ডাকে ঘরে থাকতে পারলাম না। বাইরে কাঁঠালবাগানে চেয়ার নিয়ে বসলাম। পরিচিত সব লোকজন আসছে। পাশে বসছে। একফাঁকে হযরত আলী চাচাকে বললাম, এত মানুষজন কোথা থেকে আসছে ?
হযরত আলী চাচা উৎফুল্ল স্বরে বললেন, সন্ধের পর দেখবি আরও কতজন আইসা হাজির হইছে। তুই আইছস চাইরদিকে খবর গেছে। একজন লেখক আইছে মানুষজন দেইখব না ? গেরামের একটা আদব কানুন আছে না ?
প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে কি না কে জানে! কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবারের ডাক পড়ল। রহিমা ফুপু আমাকে ডাকতে এসেছেন। সবার থেকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, সামান্য ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করেছি। খেতে আয়। কিন্তু খাবার বিষয়ে লুকোচুরির বিষয়টা আমার ভালো লাগল না। এক দিনের জন্য এসেছি, দু-একজন পরিচিতজনকে সঙ্গে নিয়েই তো খাব। আমি নিজে থেকে রাতে খাবারের ব্যবস্থা করলাম। চার কেজি ওজনের কাতল মাছ, গরুর মাংস নিয়ে আসা হলো। ভাটি অঞ্চল থেকে আনা হলো মহিষের দই।
রাতে হযরত আলী চাচা বাঁশবাগানে চাঁদ দেখার আয়োজন করলেন। বাঁশবাগানের পাশে চেয়ার-টেবিল বসালেন। ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে এলেন।
হযরত আলী চাচা গল্প বলতে লাগলেন। নৌকার মাঝে বাঘ মরার গল্প। কিন্তু গল্পগুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে যে আমার পছন্দ হলো না। বাঘও মরছে না, নৌকাও ডুবছে না। অতি দুর্বল গল্প, চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলাম। তা ছাড়া আকাশে দেখার মতন অবাককরা জোছনাও নেই।
ঘরে ঢুকে বিছানার ওপর বসেছি। জানালা খুলে দিলাম। শীতল বাতাস আসছে। সঙ্গে মন মাতালকরা সেই আতা ফুলের গন্ধ। নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে বাইরে বের হলাম। আমবাগান, কাঁঠালবাগান দিয়ে হাঁটছি। সব জায়গাতে দাদির আদরমাখা স্পর্শ অনুভব করছি। উত্তরের মাথায় কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একসময় অনুভব করলাম, দাদি একমুহূর্তের জন্যও দাদাকে ভুলতে পারেন নি। তাই তো তিনি জীবনের শেষদিকে উদাসীন বালিকার মতো হয়ে উঠেছিলেন। রাত-দিন যখন-তখন বাগান দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। মনে হলেই বড় পুত্রের কাছে ছুটে আসতেন। চোখের কোণে অজান্তেই জল এসে জমা হলো।
বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছি। শীতল বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হযরত আলী চাচার ডাকে ঘুম ভাঙল। নিশো! নিশো!
জি, চাচা।
ঘুমাচ্ছ ?
আপনার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
দরজার কাছে তোর দাদি যেন কথা বলল। যুবতী বয়সের গলা। খোঁজখবর করল।
স্তব্ধ হয়ে হযরত আলী চাচার কথা শুনে যাচ্ছি। পাখিরা ডাকছে। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। একটু পরেই অন্ধকার পরাজিত হবে ভোরের শুভ্র আলোর কাছে।
My heart to joy at the same tone
And all loved. I loved alone.
Then in my childhood, in the dawn
Of a most stormy life was drawn
From every depth of good and ill.
The mystery which binds me still.
From the torrent, or the fountain,
From the red cliff of the mountain
—Edgar Allan Poe (Alone)