
অচিন অ্যাপলের দেশে
January 27, 2025
বাবার কাছে লেখা চিঠি
January 27, 2025অপূর্ব এক ঋতু এসেছে। ঋতুরাজ বসন্ত। দুপুরবেলা। আকাশ ঘননীল । চারদিকে ঝক ঝকে রোদ। পিচ ঢালা রাস্তায় আছড়ে পড়েছে গাছের ছায়া। সব মিলিয়ে বিচিত্র এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এরকম পরিবেশ আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। কোনো কাজেই মন বসে না। এরকম হওয়ার কারণ কি? আমার জন্ম হয়েছে জোহরের ওয়াক্তে!
মার মুখে শোনা, আমার জন্ম হওয়ার পরপরই নাকি আশেপাশের সমস্ত মসজিদে জোহরের আজান দিয়েছে । তাই বাইরের কাউকে আজান দিতে হয়নি। তবুও বাবা আজান দিয়েছিলেন।
জন্ম মুহূর্তের পরিবেশ নাকি এই রকম ছিল, আকাশ ঘননীল,প্রখর রোদ। মধ্যাহ্ন ! অর্থাৎ আমি পৃথিবীতেই এসেছি এরকম এক বিচিত্র পরিবেশে।
জন্মলগ্ন এরকম সময় হওয়ার কারণে হয়তবা আমি অভিভূত হই।
লন্ডন ডেগেনহামের মানস্টর রোডে আমি যে বাসায় আছি, সেখানে বসে এরকম পরিবেশে কিছুতেই মন টিকছে না। কলেজ বন্ধ। তাই ক্লাসের কোনো ঝামেলা নেই। জাপানি ওয়াসাবি রেষ্টুরেন্টে হেমারস্মিথ ব্রাঞ্চে সহকারী সেফ হিসাবে কাজ করি। সেখানে না গেলেই নয়। কিন্তু ঘরের জানালা দিয়ে যতই বাইরে দেখছি ততই মন আর কাজে টানছে না। বাইরে ঘুরতে ইচ্ছে করছে।
হেডসেফ ওয়াংপেংকে ফোন করে আজকের দিনটা ছুটি চাইলাম। কিছুতেই ছুটি দিতে চাইলো না। অনেক বুঝালাম। আজ কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারব না। যেয়ে লাভ নেই। বুঝল না। ওয়াপেং সবকিছু শুনে বলল,তোমাকে আসতেই হবে। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে ডেগেনহাম হিথওয়ে থেকে ট্রেনে চড়ে বসলাম।
হোয়াইট চ্যাপেল এসে মনে এক বিচিত্র পরিবেশ তৈরি হলো। যেখানে নিজের স্বাধিনতা নেই সেখানে না যাওয়াই শ্রেয়। যেখানে নিজের বাক শক্তির দাম নেই। সেখানে যাব কী করতে? পরাধীনতা নিয়ে বসবাস করতে আমি পৃথিবীতে আসিনি। সেফ্কে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমি আজ থেকে আর কাজে আসব না। তুমি একটা নতুন সেফ্ ম্যানেজ করে নাও। এই ব্যবহারে আমি দুঃখিত। এবার সেফ্ আমাকে অনেক বুঝালো । ঠিক আছে, আজ তোমার ছুটি। কাল থেকে অবশ্যই আসবে। আমি বললাম, না। আমি আর তোমার রেস্টুরেন্টে কাজ করবো না । ফোন রেখে দিলাম।
মনটা খারাপ হলো। চাকরি ছেড়ে দিলাম। প্রথম লন্ডনে এসেই চাকরিটা নিয়েছিলাম। বেশকিছু স্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
প্রথম দিন ওয়াসাবিতে এসেছি। সবাই চাইনিজ, নেপালি ও জাপানি। একমাত্র আমিই বাংলাদেশি। সবাই সবার মাতৃভাষায় কথা বলছে। শুধু আমি একমাত্র ইংলিশে কথা বলছি। সেফের ইচ্ছামত কাজ করছি। এরই মধ্যে দুইবার সেফ আমার সেকশন চেঞ্জ করে দিয়েছে। একবার সুশি সেকশনে আরেকবার মাকি সেকশনে। আমি দুই জায়গাতেই পাকা হাতের কাজ দেখালাম। হেডসেফ আমার কাজে খুশি।
দুপুর বারোটার দিকে রেস্টুরেন্টে জাপানি পর্যবেক্ষক এলো । তারা সরাসরি সুশি এবং মাকি সেকশনে ঢুকল । সবাইকে কিছুনা কিছু জিজ্ঞেস করলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো কবে জয়েন্ট করেছ?
বললাম আজই প্রথম। ট্রেনিং কোথায় হয়েছে? বললাম, অক্সফোর্ড ব্রাঞ্চে। এখন কোন সেকশনে আছ ?
বললাম, মাকি ও সুশি। তারা অবাক হয়ে হেডসেফের দিকে তাকালো ।আমাকে বলল, আজ থেকে শুধু এক সেকশনে কাজ করবে। মাকি সেক্শনে।
দশম দিন। ভোর ছয়টা বাজে। মাকি সেক্শনে ঠিকঠাক মত কাজ করছি। কিন্তু রাইস যথা সময়ে সাপলাই দিতে পারছে না। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি ,সুশি সেক্শনে নতুন এক চাইনিজ মেয়ে এসেছে। সে ঠিকমত রাইস রান্না করতে পারছেনা। এমন কি রাইসে ভিনেগার মিশাতে পারছে না। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাকে সাহায্য করছি।
হঠাৎ লক্ষ করলাম চাইনিজ মেয়েটি একটি অপকর্ম করে বসেছে। সে ভিনেগার মিক্সড মেশিন উল্টাভাবে লক করে দিয়েছে। আর খোলা যাচ্ছে না। ওয়াংপেং মাথায় হাত দিয়ে বসলো।
মাথায় হাত দেওয়ার মত ব্যাপারই । লন্ডনে যতগুলো ওয়াসাবি ব্রাঞ্চ আছে তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি ব্রাঞ্চে কুকিং সেকশন আছে। এই পাঁচটি ব্রাঞ্চ থেকেই সবগুলো ব্রাঞ্চে ফুড পৌঁছানো হয়। পাঁচটি ব্রাঞ্চের যেকোন একটিতে সমস্যা হলে সবগুলোতেই সমস্যা হবে। তাছাড়া রাইস সেকশনের সঙ্গে ওয়াসাবির সবগুলো সেকশনই জড়িত। রাইস সেকশন বন্ধ মানে সব বন্ধ। ওয়াংপেং কিছু ভেবে পাচ্ছে না। এরই মধ্যে কিচেনের সবাই এক দুইবার চেষ্টা করেছে। কাজ হয়নি। আবার অনেকেই জোরে উপর দিকে টান দিয়ে খুলতে সাহস পাচ্ছেনা। কারণ একটা মেশিনের দাম প্রায় দশ হাজার পাউন্ড।
কুকিং বন্ধ দেখে ওয়াংপেং কান্না করে দিয়েছে।দৃশটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল । আমরা বাঙালি ।পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যে করতে জানিনা। আমার চোখের সামনে হেডসেফ্ অন্য ব্রাঞ্চের সেফদের কাছ ছোট হবে, তা মেনে নিতে সবাই পারলেও আমার পক্ষে সম্ভব না। পাক্কা একঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে সফল হলাম। সবাই আমাকে হাততালি দিয়ে ধন্যবাদ জানাল। সেফ আমাকে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তেই এক বিচিত্র পরিবেশ তৈরি হলো।
ওয়াসাবির সবগুলো ব্রাঞ্চে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল। কিন্ত জাতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা আমাকে কথার গোলাম বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। সে সুযোগ আমি তাদের দেই নি। আমি বাঙালি। এ জাতি অধিকার রক্ষা করতে জানে। তা আজ সেফকে হারে হারে বুঝিয়ে দিলাম। বাঙালিরা কখনো পরাধীনতা পছন্দ করে না।
হোয়াইট চ্যাপল এসে নামলাম । ইস্টিশন থেকে বের হয়ে দেখি বিশাল বাজার বসেছে। এ যেন বাঙালির চির চেনা সেই গঞ্জের হাট । রাস্তার দুপাশে জলচৌকিতে পণ্য সাজিয়ে নিয়ে বসেছে । চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিছুদূর এগোতেই দেখি -কোট, টাই, মাথায় সাহেবি টুপি পরে একজন মধ্যবয়স্ক বাঙালি লোক বাংলা ব্যানসন সিগারেট বিক্রি করছে। ওয়ান প্যাগট মাত্র চার ফাউন্ড। ওয়ান প্যাগট মাত্র চার ফাউন্ড। এক প্যাকেট কিনে নিয়ে একটা ঠোঁটে ধরালাম । হাঁটা ধরলাম।
ক্যাভিল স্ট্রিট এসে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। সেখানে এক মধ্যবয়স্ক বাঙালি বক্তব্য দিচ্ছে । কথার ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা বাংলা কিচ্ছা বলছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে নানান দেশের মানুষ।কৌতুহল নিয়ে আমি ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হলো- আমাদের সেই গ্রাম গঞ্জের হাটের মলম বিক্রি। হঠাৎ মধ্যবয়স্ক মানুষটি গান ধরল, এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা, সুরমা নদী টটে আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়, কত আনন্দ বেদনা... ।
প্রথমে ভেবেছিলাম সভ্য দেশে এসে মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে। গান শোনার পর মনে হলো, আসলে আমার ধারণা ভুল। এটি মূর্খতা না। ট্রেডিশন, ঐতিহ্য। আমরা যে বাঙালি, আমাদের যে কত সংস্কৃতি আছে তা বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া। যেমন লন্ডনের মাটিতে আলতাব আলী পার্ক । আমাদের গর্ব।
নিখিলের নায়করা হাটে-বাজারেই থাকে। তারা না থাকলে হাট-বাজার জমে উঠে না। দেশ তার নিজস্ব সংস্কৃতিকেও হারিয়ে ফেলে।
নানান দেশের মানুষের ভিড়ে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হলো। মুহূর্তেই আমি সতেরো বছর পেছনে ফিরে গেলাম।
আমার বয়স তখন নয় বছর । বকশিগঞ্জ বাজারের কাচারির সামনে এক বিশাল হাট বসেছে। বাবার সঙ্গে হাটে গিয়েছি । কাচারির মাঝখানে অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমিও ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ি।দেখি- এক মধ্যবয়স্ক লোক মলম বিক্রি করছে। মাঝে মাঝে দোতারা বাজিয়ে গান গাইছে- এই পদ্মা, মেঘনা...... ।
এই গানটি মধ্যবয়স্ক মলম বিক্রেতার মুখ থেকে আমি প্রথম শুনি।
লন্ডনের মাটিতে দাঁড়িয়েও কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও এই বাঙালি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আমার আশৈশব বকশিগঞ্জে।