
কাছের মানুষ
January 27, 2025
নিখিলের নায়ক
January 27, 2025লন্ডনে একটি বিষয় আমাকে খুব ভাবিয়েছে, তা হলো পশুপাখির সাথে ওদের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব ভালোবাসা, ভাব প্রকাশ যেন হলিউডের মুভিকেও হার মানায়।
ডেগেনহাম অফ লাইসেন্স সপে কাজ করি। এই অফ লাইসেন্স সপের প্রত্যেকটি ক্রেতাই কোলে করে কুকুর নিয়ে আসে। যদিও সপের মেইন দরজায় লেখা আছে No dog,No smoking তারা পরের বাক্যটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু প্রথমটি ঘুরিয়ে পালন করে। কুকুরকে হেটে নিয়ে আসে না। কোলে করে আনে। কুকুরের সাথে ঠোঁটে ঠোঁট মিলায়। কিস দেয়। কুকুরকে কোলে নেয় আর বাচ্চাদের টলিতে করে নিয়ে আসে।
বাচ্চারা যদি দোকানে এসে খাবার কিনতে চায় তাহলে তারা নানান ধরনের ছুতা দেখিয়ে খাবার কিনা থেকে বিরত রাখে। আর যদি কোন কুকুর দোকানে এসে মুখ দিয়ে খাবার দেখায় প্রফুল্লচিত্তে কিনে দেয়।
একদিনের কথা বলি।
আমি অফ লাইসেন্স সপে ডিউটি করছি।
একজন ভদ্রলোক এলেন। কোলে কুকুর।
সে প্রায় আশি পাউন্ড সপিং করলেন। নিজের জন্য ত্রিশ পাউন্ড আর কুকুরের জন্য পঞ্চাশ পাউন্ড। পণ্য ব্যাগে গুছিয়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানালাম।
এরপর বেশ কয়েকদিন তিনি আর আমাদের দোকানে এলেন না। দোকানের মালিক একদিন আমাকে ভদ্রলোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন- স্টিভ কয়েক দিন থেকে আমাদের দোকানে আসে না কেন। আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। কিছুদিনের মধ্যেই দোকানের মালিক কারণ খুজে বের করলেন। তিনি আমাকে জানালেন আমি নাকি তার কুকুরকে ধন্যবাদ দেই-নি। তাই সে মহা বিরক্ত। সে একটা শর্তে আসবে তার কুকুরকে স্যরি বলতে হবে। সভ্যদেশের কি কাণ্ড। লন্ডনকে নিয়ে খুব ভাবনা হলো। দেশটা কেমন জানি। ফুল আছে গন্ধ নাই; মানুষ আছে মন নাই।
মানস্টর রোডে সন্ধ্যা বেলায় প্রায় নিয়মিত হাঁটা-হাঁটি করি। সে সময় লক্ষ করি একটা বিড়াল প্রায় রাস্তায় নেমে আসে। প্রায় রাস্তার সব মানুষের কাছে আদর নিতে চায়। গাড়ি থামিয়ে পর্যন্ত বিড়ালকে আদর করে। কিন্তু বেচারা আমার কাছে কোন পাত্তা পায় না। একদিন সন্ধ্যা বেলায় হাঁটছি। হঠাৎ বিড়ালের মালিক এসে আমাকে বলল, তুমি কি আমার বিড়ালকে ঘৃণা কর?
আমি বললাম, না।
তুমি তাহলে বিড়ালকে আদর কর না কেন?
কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।
আবার বলল, তুমি তার লোমে সিথি কাটোনা কেন?
হাসলাম। আমাকে হাসতে দেখে অবাক হলো।
সে মনে করছে, আমি একজন ভিনদেশী উন্মাদ।
কুকুর নিয়ে আমার অনেক ভুল ধারণা আছে। এরই মধ্যে কথাটি জেনে গেছে আমারই এক বন্ধু কাউসার। সে ম্যানেজমেন্ট পড়ার পাশাপাশি একটা মসজিদে ইমামতিও করে।
একদিন দুপুর বেলায় তার বাসায় গিয়েছি। কাউসার খাবারের আয়োজন করেছে। নানান রকম ভর্তা, ভাজি, ডাল, কয়েক পদের মাছ। গরুর মাংস, মুরগি মাংস। খাবার শেষে সোফায় আরাম করে বসেছি। এক দু কথায় কুকুরের প্রসঙ্গে চলে এলাম। কাউসার কুকুর সম্পর্কে আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলো। বলল, শিক্ষিত কুকুর দ্বারা বাড়ি পাহারা ও শিকার করার কাজ করা যায়। বেশ কয়টা ধর্মীয় বই খুলে উদাহরণ দিলো।
দিন সাতেক পরের ঘটনা।
আমি অফ লাইসেন্স সপে ডিউটি পালন করছি। একজন অন্ধ লোক দোকানে প্রবেশ করলেন। লোককে গাইড দিচ্ছে কালো রঙের কুকুর। এই কুকুরটাকে বিশেষ ধরনের একটা কোর্স করানো হয়েছে। রাস্তা পারাপার ও চলাচল। গাড়িতে উঠানামা, দোকানে সপিং করা সম্পর্কে। আমি এই কুকুরটিকে দেখে খুব বিস্মিত হলাম।
আমি ডেগেনহামে যে বাসায় থাকি সে বাসায় আমার রুমের সাথে একটা আপেল গাছ রয়েছে। গাছটি ঝুপড়ির মতো দেখতে। রাতে প্রায় জানালা খুলে দিয়ে আপেল গাছ দেখি। হ্যান্ড রোলিং সিগারেট টানি।
একদিন লক্ষ করলাম, আপেল গাছে একটি কাঠ বিড়ালি থাকে। গাছের ডালপালায় লাফিয়ে বেড়ায়। পশ্চিমাদের ভাবের হাওয়া আমার শরীরেও লাগল। কারণ আমার সাথে কাঠ বিড়ালির একটা বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমি যখন কাঠ বিড়ালির দিকে তাকিয়ে থাকি তখন কোন এক বিচিত্র কারণে কাঠ বিড়ালিও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হয়।
যেমন
আমিঃ খবর কী রে?
কাঠ বিড়ালীঃ চুচু (ভালো)
আমিঃ আপেল খেয়েছিস?
কাঠ বিড়ালীঃ চুচু (খেয়েছি)
আমিঃ শীত লাগে?
কাঠ বিড়ালীঃ চুচু (লাগে, একটু একটু)
আপেল গাছটিও আমাকে বেশ ভাবায়। আমার চিন্তা শক্তি প্রসারিত করে। রহস্যময় জগতে আপেলে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। যেমন F=Ma এসেছে আপেলকে কেন্দ্র করেই।
প্রাচীন চিত্রকলায় আদম, ইভ এবং সর্পের সঙ্গে যে ফলটি দেখা যায় তার নাম আপেল।
পৃথিবীতে এলেন আরেক কিংবদন্তি অ্যাপলের গুরু স্টিভ জবস।
অ্যাপল নিয়ে আর মাতামাতি করলাম না। ডেগেনহাম সম্পর্কে ধারণা নিতে শুরু করলাম। তেমন কিছুই পেলাম না। শুধু একজন বৃদ্ধ মাতালকে চোখে পড়ে। বৃদ্ধের বয়স পঁচাশি কী নব্বই হবে। সব সময় মদ খায়। ড্রাঙ্ক হয়ে সন্ধ্যা বেলায় মাতলামি করে। প্রতি সন্ধ্যাতেই দেখি কারো না কারো সাথে মাতলামি করছে। হয়তবা সে আর জীবনের বাকি সময় পার করবে কিভাবে ভেবে পায় না। তাই এই মাতলামি। পশ্চিমাদের তো আর আমাদের মত চিন্তা নেই যে, ব্যাংক ব্যালেন্স করতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে ভরণপোষণ করবে কে? তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা আছে।
বৃদ্ধ ভাতা, বেকার ভাতা, আরও কত ধরনের ভাতা, তবুও তারা ভাতা নিতে রাজি না। হোয়াইট চ্যাপল একজন বৃদ্ধকে দেখতাম তিনি ফুল বিক্রি করেন।
বৃদ্ধের বয়স নব্বই এর কাছাকাছি।
একদিন তাকে বললাম, তুমি ফুল বিক্রি কর কেন? এখন তোমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। সরকার তোমাকে ভাতা দেয় না?
ওল্ড ম্যান আমাকে রাগ করে বলল, আমি কেন দেশের ঘাড়ে বসে খাব?
আমি কী পরিশ্রম করে উপার্জন করতে জানি না।
যা হোক মূল গল্পে ফিরে আসি।
বৃদ্ধ মাতাল একদিন আমাকে পেয়ে বসলেন। সন্ধ্যা বেলায় হাঁটছি হঠাৎ আমার কাছে এগিয়ে এলো।
প্রথমেই তার জেকেটের পকেট থেকে হুইস্কি বের করে দিলেন। বললাম, এই সব পান করি না। সে কারণ জিজ্ঞেস করল। বললাম, আমি মুসলিম। মুসলমান ধর্মে মদ খাওয়া নিষেধ। হুইস্কির বোতল জেকেটের পকেটে ঢুকালো। আমার সাথে গল্প শুরু করল। পড়াশুনা, দেশ, তার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে নিয়ে। সবশেষে ডেগেনহাম সম্পর্কে পরিচয় করে দিলো।
বলল, এখানে অনেক বিখ্যাত একজন বাস করতেন। তার নাম আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছেন। যখন বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিলাম তখন সে অন্য পকেট থেকে একটা আপেল বের করে দিলো। অভিভূত হলাম। অনেক শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
স্যার আইজাক নিউটনের দেশ, আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং এর দেশ, শেক্স পিয়ারের দেশ, অচীন আপেলের দেশ ইংল্যান্ড।